🖌 মাওলানা মুস্তাফীদ রশীদ
গত ১৮ই জুমাদাল আখিরাহ একজন শ্রদ্ধেয় আলেম, কবি ও লেখকের একটি আলোচনার ভিডিও ক্লিপ আমাদের নিকট ‘তাবসেরা’র জন্য আসে, যার বিষয়বস্তু হলো, ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী রহিমাহুল্লহর ইলমী শ্রেষ্ঠত্বের মূলতত্ত্ব। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে শ্রদ্ধেয় আলোচক দায়িত্বশীলতার পরিচয় না দিয়ে, বরং বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ও তত্ত্বের পসরা সাজান। ইলমী আমানতের দাবী ছিল, উক্ত আলোচনার ওপর গঠনমূলক পর্যালোচনা পেশ করা; কিন্তু তখন সে সুযোগ হয়ে উঠেনি। এছাড়াও গঠনমূলক পর্যালোচনার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণের কিছু দুঃখজনক চিত্রও আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করে।
ইতোমধ্যে ঢাকার একজন নবীন ফাযেল তালিবে ইলম মাওলানা মুস্তাফীদ রশীদের পক্ষ থেকে একটি ‘তাবসেরা’ আমাদের হস্তগত হয়। যেহেতু আলোচিত বক্তব্যে তথ্যগত ভুলসমূহের পাশাপাশি কিছু বড় ফিকরী বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, তাও আবার শাহ সাহেব রহিমাহুল্লাহর মত ব্যক্তিত্ব ও তার তুরাসের প্রতি সম্বন্ধ করে—তাই আমরা মুরুব্বীদের সাথে পরামর্শ করে নযরে সানীর পর এটি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি।
বলাবাহুল্য, আলোচক ও পাঠকসমাজ উভয়ের প্রতি পরিপূর্ণ হিতাকাঙ্ক্ষিতা ও ইলমী আমানতের জযবা থেকেই ‘তাবসেরা’টি প্রকাশ করা হচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ। মুহতারাম আলোচকের নামটিও ইচ্ছে করেই অনুল্লেখ রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, পর্যালোচনার ভাষা পর্যালোচিত বক্তব্যের অনুগামী; বক্তব্যের যে অংশ যে মাত্রায় আপত্তিকর, তার পর্যালোচনাও ‘আদাবুন নাকদ’ অনুযায়ী সে মাত্রায় কঠিন বা কোমল হতে বাধ্য। এ ধরনের পর্যালোচনাকে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ, আপনত্ব ও পারস্পরিক হৃদ্যতার বিপরীত তিনিই ভাবতে পারেন, যিনি ইলমী অঙ্গনের ঐতিহ্যগত ‘নাকদের’ বৈশিষ্ট্য ও এর সোনালী ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা রাখেন না।
আল্লাহপাক পর্যালোচনাটির লেখককে জাযায়ে খাইর দান করুন, আমাদেরকে দ্বীন ও ইলমের বিষয়ে পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বনের তাওফীক দান করুন। – মাআরিফ
*******
গত ১৭ই রবীউল আখের, ১৪৪৬ মুতাবিক ২১ অক্টোবর, ২০২৪-এ অনলাইনে একজন শ্রদ্ধেয় আলেম ও লেখক নিজের একটি আলোচনার ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেন, এবং এটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। আলোচনার বিষয় ছিল, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী রহ.-এর ব্যক্তিত্বের আসল বৈশিষ্ট্যসমূহ কী, সে বিষয়ে পর্যালোচনা; তাঁর আধ্যাত্মিকতা, কিছু রচনা পরিচিতি ও তার আলোকে হাদীস শাস্ত্রে তাঁর বিশেষত্ব ইত্যাদি। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনাটিতে প্রদত্ত কিছু তথ্য ও তত্ত্বের পর্যালোচনা পেশ করার চেষ্টা করছি। আল্লাহ তাআলাই উত্তম তাওফিকদাতা।
তাসাওউফই শাহ ওয়ালিউল্লাহর ‘সমস্ত কিছুর সমস্ত কিছু’?
আলোচক বলেন, “শাহ ওয়ালিউল্লাহকে বোঝার জন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় হল, তার তাসাওউফকে বোঝা। কারণ যে সমস্ত উপাদান দিয়ে তাঁর সত্ত্বা গঠিত হয়েছে তার মর্মমূলে রয়েছে এই তাসাওউফ। এই তাসাওউফই হল ‘তাঁর সমস্ত কিছুর সমস্ত কিছু’।” (ক্লিপ ২:০০-২:২২)
শাহ সাহেবের তুরাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল যে কারো জানা থাকার কথা যে, তাঁর মত মহা মনীষীর ইলমী উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্বের নানাবিধ কারণ ও বিস্তৃত উপলক্ষ্য রয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে তিনি হিন্দুস্তানের ভূমিতে এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের মূল উপাদান হিসেবে শুধু তাসাওউফকেই নির্দিষ্ট করে ফেলাটা খুবই একপেশে ও অবিবেচনাপ্রসূত মূল্যায়ন। শুধু তাসাওউফই যদি শাহ সাহেবের বিশেষত্বের মূল উপাদান হয়, তাহলে এই উপাদান ও মাপকাঠি তো তার পূর্ববর্তী, সমকালীন ও পরবর্তী বহু মাশায়েখের মধ্যে বিপুল মাত্রায় বিদ্যমান ছিল; এতে শাহ সাহেবের বিশেষত্ব কীভাবে প্রমাণিত হয়? শুধু ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’-এর লেখক হিসেবেও শাহ সাহেবের ব্যক্তিত্ব আরো বিশেষায়িত মূল্যায়নের দাবী রাখে।
এতটুকু পর্যন্ত তো বিষয়টি অনেকটা সাধারণ। বলা যায়, একজন মনীষীর ইলমী ব্যক্তিত্বের একপেশে মূল্যায়ন। কিন্তু ‘আদ-দুররুস সামীন’ সংক্রান্ত পরবর্তী আলোচনার পটভূমি ও ভূমিকা হিসেবে বিবেচেনা করা হলে বিষয়টি বেশ সমস্যাজনক মনে হয়। (‘আদ দুররুস সামীন’ সংক্রান্ত আলোচনার সাথে মিলিয়ে পড়ুন)।
শাহ সাহেবের রচনা ‘আল ইরশাদ ইলা মুহিম্মাতিল ইসনাদ’ প্রসঙ্গ
তিনি বলেন, “শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. হজের সময় যেসমস্ত মাশায়েখের সোহবত লাভ করেছেন তাদের সম্পর্কে একটি কিতাব লিখেছেন। সেটির নাম হল الإرشاد إلى مهمات الإسناد। এই কিতাবটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” (ক্লিপ ২:৩০-২:৫০)
শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. (১১১৪-১১৭৬) এই কিতাব রচনা করেছেন হাদীসের কিতাবগুলোর সনদ পরম্পরা সংরক্ষণ করার জন্য। এতে তিনি নিজ সূত্রে হাদীস শাস্ত্রের প্রায় ৪০টি গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের সনদ মুসান্নিফগণ পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। এই কিতাবে তিনি নিজ শায়খ আবু তাহের মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম কুরদী (১০৮১-১১৪৫) ও অন্যান্যদের সূত্রে সাতজন মাশায়েখে হাদীসের ‘আসবাত’ ও মাশাইখের বিবরণ উল্লেখ করেন। তারা হলেন যথাক্রমে- মুহাম্মাদ ইবনুল আলা আল-বাবিলী (ওফাত: ১০৭৭ হি.), ঈসা আল-মাগরিবী (ওফাত: ১০৮০), মুহাম্মাদ ইবনে সুলাইমান আর-রুদানী (১০৩৭-১০৯৪), ইবরাহীম ইবনে হাসান আল-কুরদী (১০২৫-১১০১), হাসান ইবনে আলী আল-উজাইমি (ওফাত: ১১১৩), আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ আন-নাখলী (ওফাত: ১১৩০), এবং আব্দুল্লাহ ইবনে সালেম আল-বাসরী (১০৫০-১১৩৪) রহিমাহুমুল্লাহ।
বোঝার বিষয় হলো, বিভিন্ন সূত্রে শাহ সাহেব, (বিশেষভাবে) হারামাইনে প্রসিদ্ধ এই সাতজন মুসনিদ মুহাদ্দিসের রিওয়ায়াতকৃত কিতাবাদির ইজাযত লাভ করেছেন। সূত্রগুলো শাহ সাহেব রিসালাটিতে নিজেই উল্লেখ করেছেন।
অতএব, এই সাতজনের কেউই শাহ সাহেবের সরাসরি শাইখ নন। আর তা কীভাবেই সম্ভব, যেখানে শাহ সাহেব আরবদেশে গমন করেন ১১৪৩ হিজরীতে (এবং সেখানে দুই বছর অবস্থান করেন, যা খুবই প্রসিদ্ধ বিষয়)। এ সময় উপরোক্ত সাতজনের কেউই জীবিত ছিলেন না। সবার নামের পরে উল্লিখিত মৃত্যু বা জন্ম-মৃত্যুর তারিখ দ্রষ্টব্য। তারিখগুলো দেখলে বোঝা যায় যে, তাদের অধিকাংশের ওয়াফাত হয়েছে শাহ সাহেবের জন্মেরও আগে। তাই, এই মাশাইখের সাথে, যাদেরকে নিয়ে “আল-ইরশাদ” কিতাবটি লেখা হয়েছে—শাহ সাহেবের কীভাবে হজের সফরে সাক্ষাৎ বা সুহবতের সুযোগ হলো, তা আমাদের বোধগম্য নয়! হ্যাঁ, যেসব শাইখের সূত্রে বা ওয়াসিতায় উপরোল্লিখিত মাশাইখের ইজাযতসমূহ লাভ করেছেন, তাদের সাথে হজে সাক্ষাৎ হতে পারে; কিন্তু না তাদেরকে নিয়ে এই গ্রন্থ, আর না গ্রন্থটির কোথাও এমন উল্লেখ আছে যে, ‘হজের সময় মাশায়েখের সোহবত লাভ’-এর প্রেক্ষাপটে এটি রচিত হয়েছে।
“পড়েছো ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’?”
তিনি আরও বলেন, “এই কিতাবের (আল ইরশাদ) ধাঁচকে অবলম্বন করে শাহ আব্দুল আজীজ রাহ. একটি কিতাব রচনা করেন। সেটির নাম হল- بستان المحدثين। পড়েছো ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’? অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।” (ক্লিপ ৩:০৫-৩:১৭)
আশ্চর্যের বিষয় হলো- শাহ আব্দুল আজীজ রহ. এর ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’ কিতাবটি বিষয়, বিন্যাস, ধাঁচ ও প্রেক্ষাপটসহ যাবতীয় বিবেচনায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর ‘আল ইরশাদ’ কিতাবটির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’-এর আলোচ্য বিষয় হল, হাদীস শাস্ত্রের আকর গ্রন্থগুলোর পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও বিন্যাস নিয়ে আলোচনা করা এবং সেগুলোর মুসান্নিফদের পরিচয় প্রদান করা, আর সংশ্লিষ্ট ভাষ্যগ্রন্থগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এতে সনদ পরম্পরাগত কোনো আলোচনা নেই। অন্যদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.-এর ‘আল ইরশাদ’ কিতাবটি আগাগোড়া সনদ বিষয়ক আলোচনায় ভরপুর, আর গ্রন্থ-পরিচিতিমূলক আলোচনা এতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মোটকথা শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর ‘আল ইরশাদ’ ও শাহ আব্দুল আজীজ রহ.-এর ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’ গ্রন্থ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের!
সম্মানিত আলোচক বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করলেন, যেন বই দুটির সঙ্গে তার পরিচয় চাক্ষুষ ও প্রত্যক্ষ। মনে হচ্ছে, বই দুটি পড়েই তিনি উক্ত মন্তব্য করছেন। অধিকন্তু তিনি যখন তার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে সুদৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে এভাবে বলছেন, “পড়েছো ‘বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন’?” তখন এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়। বাস্তবতা হল, তিনি নিজেই উক্ত দুই কিতাবের শুরু ও শেষের কয়েক পৃষ্ঠা নেড়েচেড়ে দেখার কষ্টটুকু স্বীকার করেননি। নাহয় তার সামনেই কিতাব দুটির ভিন্নতা জলের মত পরিষ্কার হয়ে যেত। মাধ্যমিক স্তরের একজন সাধারণ তালিবুল ইলমও যদি বই দুটি পাশাপাশি রেখে শুধু সূচিপত্রের উপর একবার দৃষ্টি বুলায়, তার সামনে দুই কিতাবের বৈসাদৃশ্য স্পষ্ট হয়ে যাবে।
*******
মূল প্রসঙ্গ:
শাহ সাহেবের রচনা ‘আদ-দুররুস সামীন’: আলোচকের দাবী ও বাস্তবতা
আলোচক বলেন, “আমি তাঁর একটি কিতাবের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যার নাম হল-الدر الثمين في مبشرات النبي الأمين। তিনি এই কিতাবে এমন কতিপয় হাদীস একত্রিত করেছেন যেগুলোতে নবীজী ও তার মাঝে কেবল এক-দুই বা তিন মধ্যস্থতা রয়েছে। এটা হল তার বিশেষত্বের এমন একটি জায়গা যেখানে তার তুল্য উম্মতের মধ্যে খুব কম আলেমকেই পাওয়া যায়। বলতে গেলে পাওয়াই যায় না।” (ক্লিপ ৩:৪৫-৪:৪৫)
আরও বলেন, “শাহ ওয়ালিউল্লাহ আবু তাহের কুরদীর সূত্রে একটি ‘আরবাঈন’ রচনা করার পর বলেন, আমি এখন আরেকটি ‘আরবাঈন’ লিখছি, যেখানে ৪০টি বিশেষ ধরনের হাদীস একত্রিত করছি:
هذه أربعون حديثا من أحاديث النبي صلى الله عليه وسلم، التي تروى من جهة الرؤيا أو من جهة مشاهدة روحه الكريم، جمعتها في هذه الرسالة، منها ما لا واسطة بيني وبينه، ومنها ما يكون بيني وبينه واسطة واحدة، ومنها ما يكون بيني وبينه واسطتان فأكثر. (الدر الثمين ص 1)
অর্থাৎ এগুলোর মধ্য থেকে কিছু হাদীস নবীজী থেকে স্বপ্নযোগে বর্ণিত, আর অবশিষ্টগুলো জাগ্রত অবস্থায় নবীজীর পবিত্র রূহ মোবারকের সঙ্গে মোলাকাত থেকে প্রাপ্ত।” (ক্লিপ ৫:৫৫-৮:৫৫)
মোটকথা, আলোচকের দৃষ্টিতে ‘আদ-দুররুস সামীন’ নামক রিসালাটিতে উদ্ধৃত রিওয়ায়াতসমূহ হলো শাহ সাহেবের বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অনন্য নিদর্শন, যেখানে তাঁর তুল্য আলেম এই উম্মতের মাঝে নেই বললেই চলে!
এই প্যারাগুলোতে মূলত বেশ কয়েকটি বড় বড় দাবী পেশ করা হয়েছে। যেমন মূল প্রসঙ্গের বাইরে, এটিও একটি আশ্চর্যজনক দাবী যে, উম্মাহর ইতিহাসে এজাতীয় কাশফ-মানাম ও মুরাকাবার মাধ্যমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ‘মুলাকাত’ ও কিছু ‘রিওয়ায়াত’ যেন আর কেউ করেননি। অথচ তারাজিম ও ফাহারিসের কিতাবগুলোতে নজর বুলালে প্রতি শতকেই উম্মতে মারহূমার এমন অনেক মনীষীর হালত পাওয়া যাবে, যাদের ক্ষেত্র্রে এধরনের বিষয়গুলো ঘটেছে। এগুলোকে হকপন্থী আলিমগণ কখনো কারো ইলমী শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বানাননি।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গ, অর্থাৎ আলোচ্য কিতাব ও এর মাযমুনের বিষয়ে আরজ হলো-
শ্রদ্ধেয় আলোচক না এই কিতাবের মাজাল-মাকাম বা ‘হাইসিয়তের’ সঠিক উপস্থাপন করেছেন, না মাযমুন বা উদ্ধৃত রিওয়ায়াতসমূহের ব্যাপারে সঠিক কোনো মূল্যায়ন পেশ করেছেন। উভয় বিষয়ে মৌলিক ধারণার জন্য পাঠকের সমীপে কিছু কথা-
ক) ‘আদ-দুররুস সামীন’ রচনার প্রেক্ষাপট, নুসখা ও খোদ শাহ সাহেবের দৃষ্টিতে এর মাকাম:
– ‘আদ-দুররুস সামীন’ (الدر الثمين في مبشرات النبي الأمين) নামক এই রিসালাটির সাথে সংশ্লিষ্ট শাহ সাহেব রহিমাহুল্লাহর আরেকটি রিসালা হলো ‘আন-নাওয়াদির’ (النوادر من أحاديث سيد الأوائل والأواخر)। উভয়টির রচনার প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু প্রায় অভিন্ন, তাই একটিকে বোঝার জন্য অন্যটিও সামনে রাখতে হবে। ‘আন-নাওয়াদির’ রচনার আগেই শাহ সাহেব রাহ. এই রচনার বিষয়ে অন্য একটি কিতাবে আলোচনা করেছেন। তিনি إتحاف النبيه لما يحتاج إليه المحدث والفقيه গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
وأما النوادر: وأعني بها الأحاديث التي تروى من جهة الرؤيا الصادقة أو من جهة مشاهدة الروح أو من جهة الخضر أو من جهة الجِنِّ ونحو ذلك، ولا تقومُ بمثل هذه الأحاديث الحُجَّةُ، وإنما يستأنس بها – فهي كثيرة، أذكر منها ههنا أربعين حديثا، منها ما لا واسطة بيني وبينه صلى الله عليه وسلم، ومنها ما يكون بيني وبينه واسطة واحدة، ومنها ما يكون واسطتان أو أكثر من ذلك. انتهى. (ص 78-79)
এখানে তিনি উপরোক্ত দুই কিতাবের রচনা-প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও হাইসিয়ত-মাকাম নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা করেছেন। তবে এটি ছিল পূর্ব-পরিকল্পনা, যেখানে শুধু ‘আন-নাওয়াদির’ শিরোনামই ছিল। (দ্রষ্টব্য- ‘আল ফাযলুল মুবীন’-এর ভূমিকা, মাওলানা নুরুল হাসান রাশেদ কান্ধলবী, পৃ. ১৪২)। পরে রিওয়ায়াতগুলোকে দুই কিতাবে/দুই শিরোনামে সংকলন করা হয়। স্বপ্ন, কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে প্রাপ্ত সুসংবাদ ও বিষয়াদি الدر الثمين -এ অন্তর্ভুক্ত হয়। আর মুসনাদে জিন, মুসনাদে খাযির প্রভৃতি বিষয়ক বর্ণনাগুলো النوادر -এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, রিসালা দুটি যে খোদ শাহ সাহেবের নিকট অভিন্ন মর্তবার অধিকারী। এখানে রিসালাদ্বয়ে উদ্ধৃত রিওয়ায়াতগুলো সম্পর্কে তিনি বলছেন-
.ولا تقومُ بمثل هذه الأحاديث الحُجَّةُ، وإنما يستأنس بها
এতো হলো রচনার আগের কথা। পরে ‘আন-নাওয়াদিরের’ ভূমিকায়ও তিনি একই কথা বলেন, যা আরো গুরুতরভাবে ‘আদ-দুররুস সামীনের’ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-
.”هذه أحاديث نادرة من مسند الجن ومسند الخضر ومسند المعمرين المختلف في صحبتهم، جمعتها في هذه الرسالة استغرابا لها لا تنويها بصحتها، وسميتها بـ “النوادر من أحاديث سيد الأوائل والأواخر
মোটকথা, রিওয়ায়াতগুলো খোদ লেখকের নিকটই সহীহ ও গ্রহণযোগ্য নয়; বরং সামগ্রিক বিভিন্ন ইলমী প্রেক্ষিত ও নকল-জমা’-এর প্রয়োজনে তিনি এগুলো সংকলন করেছেন। এ ধরনের সংকলন পূর্ববর্তী আরো অনেক আলেমেরও রয়েছে। আর ‘আন-নাওয়াদিরে’ অন্তর্ভুক্ত রিওয়ায়াতগুলোর সাথে ইসনাদের সম্পর্ক হলেও আছে; কিন্তু ‘আদ-দুররুস সামীন’-এর মাযমুনগুলোর সাথে তো ইসনাদ ও ইলমুল ইসনাদের সম্পর্কই নেই, যেমনটি সামনে আসছে।
বিশিষ্ট মুহাক্কিক মাওলানা নুরুল হাসান রাশেদ কান্ধলবী হাফিযাহুল্লাহ, শাহ সাহেব রহ.-এর আরেকটি প্রসিদ্ধ রচনা الفضل المبين -এর সম্পাদনার ভূমিকায় লিখেন- النوادر ও الفضل المبين অধ্যয়ন করলে এই বিষয়টি উপলব্ধি করা যায় যে, খুব সম্ভব শাহ সাহেব এগুলো তাৎক্ষণিক প্রয়োজন সামনে রেখে, অথবা কোনো ছাত্রের জরুরত পূরণ করতে গিয়ে রচনা করেছেন; খুব গভীরভাবে এতে মনোযোগ নিবদ্ধ করার সুযোগ হয়নি। ফলে এগুলোতে ভাসাভাসা দৃষ্টি ও তাড়াহুড়োর প্রভাব রয়ে গেছে। যেমন, এই কিতাবগুলোতে শাস্ত্রীয় কোনো বিন্যাস নেই। বিষয়বস্তুর কোনো ধারাবাহিকতা নেই। মাশায়েখ থেকে হাদীস উদ্ধৃত করার অনুসৃত কোনো পন্থা নেই। (পৃ. ১৪৯)
উল্লেখ্য, মাওলানা নুরুল হাসান রাশেদ সাহেব, শাহ সাহেবের ‘মুসালসালাত’ সমগ্রের তিনটি কিতাব- ‘আল ফাযলুল মুবীন’, ‘আদ-দুররুস সামীন’ ও ‘আন-নাওয়াদির’-এর নুসখা সম্পাদক। তার তাহকীক, সম্পাদনা ও টীকা সহকারে কিতাবত্রয়ের এযাবৎকালের বিশুদ্ধতম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। উপরোল্লিখিত ‘আদ-দুররুস সামীন’ ও ‘আন-নাওয়াদির’ রিসালাদ্বয়ের হালত নিয়ে তিনিও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আগে এই দুই রিসালা ‘আল ফাযলুল মুবীন’ সহ একসাথেই প্রকাশিত ছিল; কিন্তু তিনি আলোচিত রিসালাদ্বয়কে আলাদা প্রকাশ করেছেন। তার আলোচনার কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করে বিষয়টি শেষ করছি। রিসালাদ্বয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেন-
– “শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দা.বা. আমাকে মৌখিক ও লিখিতভাবে এই নির্দেশনা দিয়েছেন যে, রিসালা দুটি যেন الفضل المبين -এর সঙ্গে একত্রে প্রকাশ না করা হয়। রিসালাদ্বয় সম্পর্কে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা দা.বা.-এর মতও অনুরূপ।
আমি ইতিপূর্বে রিসালা তিনটি একত্রে প্রকাশের ইচ্ছা করেছিলাম এবং সেভাবেই কাজ করেছিলাম; কিন্তু এই দুই মনীষির বক্তব্যের আলোকে এটি মোটেও সমীচীন ছিল না। যার ফলে আমি সেই সংকল্প পরিত্যাগ করি, এবং الفضل المبين -কে স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করি, আর النوادر ও الدر الثمين কে এখন একত্রে প্রকাশ করছি। النوادر ও الدر الثمين সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা الفضل المبين -এর ভূমিকায় পাওয়া যাবে।” (পৃ. ১৩ – ১৪)
– “এ দুটি রিসালার এমন কোনো প্রাচীন নুসখা বা অনুলিপি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যা শাহ সাহেব রহ.-এর হাতে লেখা, বা তার দরসে পঠিত হয়েছে, অথবা সেটিতে শাহ সাহেবের কলমে লিখিত ইজাযতনামা রয়েছে। শাহ সাহেবের শিষ্যদের হস্তলিখিত কিংবা তাদের সময়ে প্রস্তুতকৃত কোনো নুসখাও পাওয়া যায়নি। আরো বড় বিস্ময়ের বিষয় হল, এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোনো নুসখার আলোচনাও আমরা কোথাও পাইনি।
এ যাবৎ উভয় রিসালার যে দুটি পুরনো অনুলিপি পাওয়া গেছে সেগুলো মাওলানা মুফতী আব্দুল কাইউম বুড্ডানবী রাহ. এর হাতে ১২৫৩ হিজরীতে লেখা। এর চেয়ে প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপি বা অনুলিপি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।” (পৃ. ১৩)
উপরোক্ত বিবরণ থেকে রিসালাদ্বয়ের রচনার প্রেক্ষাপট ও এতে উদ্ধৃত রিওয়ায়াতসমূহের হালত জানা গেল। আর খোদ হিন্দুস্তানেই রচনা দুটির প্রাচীন নুসখা না পাওয়া যাওয়া, এছাড়াও মুহাক্কিক আহলে ইলমদের দৃষ্টিতে এগুলোকে ‘আল-ফযলুল মুবীনের’ মত হাদীসগ্রন্থের সাথে প্রকাশ না করার তাগাদা থেকে সুস্পষ্টরূপে বোঝা গেল, আহলে ইলমগণ রিসালাদ্বয়কে কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন। বস্তুত রিসালা দুটি বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিক পুস্তিকা হিসেবে মূল্যবান ‘তুরাস’ হলেও, শরয়ী ও ইলমী মাপকাঠিতে তারা এর মাযমুনকে কখনো গ্রহণযোগ্য বলেননি। ভারত উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশিত হয়ে আসলেও এতদঞ্চলের আহলে ইলম ও আকাবিরে দেওবন্দের কাছে এটি কোনোকালেই উপরোক্ত অর্থে সমাদৃত হয়নি (শ্রেষ্ঠত্বের কোনো নির্ণায়ক হওয়া তো অনেক দূরের বিষয়!!)। আর হবেও কীভাবে, যেখানে স্বয়ং শাহ সাহেব রহ. এতে উদ্ধৃত রিওয়ায়াতগুলোকে স্পষ্ট ভাষায় অপ্রামাণ্য বলে উল্লেখ করেছেন। শেষোক্ত বিষয়ে আরো কিছু কথা পরের প্যারাগুলোতে।
খ) ‘আদ-দুররুস সামীন’-এ উদ্ধৃত রিওয়ায়াতসমূহের অবস্থা ও আলোচকের দাবী
আলোচক বলেন, “এই জাতীয় হাদীসগুলো অসাধারণ ও বিরল প্রকৃতির হাদীসের আওতায় পড়ে। তবে এগুলোর শান-মান, মাকাম ও অবস্থান এবং এগুলো থেকে কোনো শরঈ হুকুম নাফেয করা হবে কিনা- সেটা আলাদা আলোচ্য বিষয়।” (ক্লিপ ৯:১০-১০:০০)
তিনি আরও বলেন, “তিনি নবীজীর সঙ্গে তাআল্লুকের এমন এক স্তরে অবস্থান করছিলেন যেখানে হঠাৎ একবার সাক্ষাত নয়, বরং অনবরত অবিরাম অবিরল ও ধারাবাহিক সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তিনি ৪০টি হাদীস একেবারে নিশ্চিত হয়ে, অবিকৃত ও সুরক্ষিত রেখে গোটা হাদীসগুলোকে সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন।” (ক্লিপ ১০:১০-১০:৫০)
ভেবে দেখুন, পূর্বোল্লিখিত ‘আদ-দুররুস সামীনের’ রচনা-প্রেক্ষাপট, নুসখার হালত ইত্যাদি বিষয়, এছাড়াও এতে উদ্ধৃত রিওয়ায়াতসমূহের ব্যাপারে শাহ সাহেব রহ.-এর বক্তব্য না জানা থাকলেও এতটুকু বিষয় যেকোনো হাদীসের তালিবে ইলমের জানা আছে যে, কাশফ, স্বপ্ন ও মুশাহাদা-মুরাকাবার মাধ্যমে কোনো হাদীস কেন, শরীয়তের কোনো বিষয়ই প্রমাণিত হয় না। এতটুকু পর্যন্ত বিষয়টি ইজমাঈ বা সর্ববাদীসম্মত। এ ধরনের সূত্রে প্রাপ্ত কোনো রিওয়ায়াতকে “অসাধারণ ও বিরল প্রকৃতির হাদীস” বলা এবং “একেবারে নিশ্চিত হয়ে, অবিকৃত ও সুরক্ষিত রেখে গোটা হাদীসগুলোকে সংরক্ষণ” করে এগুলো রিওয়ায়াত করা হয়েছে বলাটা তো হুজ্জিয়্যাতের সর্বোচ্চ পর্যায় বোঝায়। এরপর “কোনো শরঈ হুকুম নাফেয করা হবে কিনা- সেটা আলাদা আলোচ্য বিষয়।”-বলার কী অর্থ? এ তো স্রেফ দায়মুক্তির ব্যর্থ চেষ্টা।
আমাদের সবিনয় নিবেদন হল-
১) এমন স্পর্শকাতর জায়গায় একজন রুচিশীল লেখকের জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে “অনবরত, অবিরাম, অবিরল ও ধারাবাহিক সাক্ষাত”-এর মত ভারী শব্দাবলীর বে-ধড়ক ও লাগামহীন ব্যবহার খুবই আপত্তিকর ও গর্হিত বিষয়। শরীয়তের অভিপ্রায় ও ভাষা-সাহিত্যের নিয়ম হিসেবেও এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত শব্দপ্রয়োগ জরুরি ছিল।
২) এখানে আলোচক দাবি করেছেন যে, স্বয়ং শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. নাকি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ৪০টি হাদীস লাভ করেছেন। অর্থাৎ ‘আদ দুররুস সামীন’-এর গোটা ৪০টি হাদীসই সরাসরি লেখক শাহ সাহেবের সূত্রে বর্ণিত। অথচ বিষয়টি কোনোক্রমেই এমন নয়; বরং উক্ত কিতাবের ৪০টি বর্ণনার সূত্র সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
মাত্র ১৩টি হাদীস শাহ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের সূত্রে বর্ণিত। ১৫টি হাদীস তাঁর পিতা শাহ আব্দুর রহীম-এর সূত্রে পাওয়া। ২টি হাদীস তাঁর চাচা শায়খ আবুর রিযা-এর সূত্রে প্রাপ্ত। ৯টি হাদীস তাঁর শায়খ আবু তাহের কুরদীর সূত্রে। আর ১টি হাদীস শায়েখ উমর ইবনে বিনতে আব্দুল্লাহ বিন সালেম এর সূত্রে বর্ণিত।
আসলে সম্মানিত আলোচক তার হাতের কাছে বিদ্যমান ও সামনে উন্মুক্ত ‘আদ দুররুস সামীন’-এর মতো ১২ পৃষ্ঠা কলেবরের ৪০টি হাদীসের এই অতিক্ষুদ্র সংকলনটিও আগাগোড়া ভালোকরে দেখেননি। তিনি শুধু বইটির ভূমিকা দেখে দেখে শ্রোতাদের পাঠ করে শুনাচ্ছেন। ভূমিকাপরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়ে চোখ তুলে তাকানোর ফুরসতটুকু বোধ হয় তার হয়নি। তাহলে অন্তত এমন অবাস্তব, কাঁচা গলদ ও আপত্তিকর বক্তব্য তার যবান থেকে বের হতে পারত না।
(৩) শাহ ওয়ালিউল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি যদি ‘আদ দুররুস সামীন’ গ্রন্থটি হয়, আর তা এজন্য যে নবীজি থেকে স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থায় তার হাদীস লাভ করা, তাহলে বাস্তবতা ও যুক্তির দাবি হল, এ কারণে শ্রেষ্ঠ হবেন তাঁর পিতা শাহ আব্দুর রহীম; পুত্র শাহ ওয়ালিউল্লাহ নন। কেননা উক্ত রিসালাতে শাহ আব্দুর রহীমের সূত্রে নবীজি থেকে ১৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর শাহ ওয়ালিউল্লাহ থেকে মাত্র ১৩টি। ফলে পিতার বর্ণনার সংখ্যা পুত্রের বর্ণনার চেয়ে দুটি বেশি। আর আবু তাহের কুরদীও তাদের থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নন।
(৪) মূলত ‘আদ-দুররুস সামীনে’ যে রিওয়ায়াতগুলো স্থান পেয়েছে, সেগুলোকে শাস্ত্রীয় পরিভাষায় “হাদীস” বলার সুযোগ নেই। এমনকি ‘আন-নাওয়াদিরের’ মূল নামে ‘আহাদীস’ শব্দ ব্যবহার করা হলেও (النوادر من أحاديث سيد الأوائل والأواخر) ‘আদ-দুররুস সামীনের’ মূল নামেও ব্যবহৃত হয়েছে ‘মুবাশশিরাত’ শব্দটি (الدر الثمين في مبشرات النبي الأمين)। এটিই স্বপ্ন, কাশফ ও মুরাকাবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে যথাযথ শব্দ, যার ব্যবহার শরয়ী নুসুসেও হয়েছে। হ্যাঁ, (‘আদ-দুররুস সামীনের’) ভূমিকায় ব্যবহৃত ‘হাদীস’ বা ‘আহাদীস’ শব্দপ্রয়োগটি একটি রূপক ব্যবহার। একে কেন্দ্র করে কেউ কাশফ, স্বপ্ন ও মুরাকাবা-মুশাহাদাগুলোকে হাদীসের মর্যাদা দান করলে বা এগুলোকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বানালে, সে দ্বীনী সমঝের ক্ষেত্রে দৈন্যের স্বাক্ষর রাখল এবং আহলুস সুন্নাহর মুহাক্কিক উলামার স্বীকৃত মাওকিফের বিরুদ্ধাচরণ করল। এগুলোকে “অসাধারণ হাদীসের আওতায় পড়ে” বলা, তদুপরি এভাবে উপস্থাপন করা যে, “অনবরত অবিরাম অবিরল ও ধারাবাহিক সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে… একেবারে নিশ্চিত হয়ে, অবিকৃত ও সুরক্ষিত রেখে গোটা হাদীসগুলোকে তিনি সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন”- তো রীতিমত অন্যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এমন আস্ফালন থেকে বাঁচিয়ে রাখুন।
(৫) স্বপ্ন ও কাশফ-মুশাহাদা যদি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হয়, তাহলে এমন কাশফ তো বহুগুণ মাত্রায় আরও অনেক বুযুর্গদের সঙ্গেও ঘটেছে। যেমন শাহ সাহেবের নাতি শিষ্য মাওলানা ফযলুর রাহমান গঞ্জেমুরাদাবাদীর অলৌকিক ঘটনাবলী ও কাশফের বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন পাঠকমাত্রই অবগত। অতএব এটা মেনে নিতে হবে যে, গঞ্জেমুরাদাবাদী তার দাদা উস্তায শাহ সাহেবকে ছাড়িয়ে গেলেন!
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী রহ.-এর মতো ব্যক্তিত্বের ইলমী কারনামা ও শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হিসেবে তার রেখে যাওয়া বহু কালজয়ী গ্রন্থ রয়েছে। যেমন, ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’, ‘ইযালাতুল খাফা’, পবিত্র কুরআন কারীমের ফার্সী তরজমা ও মুয়াত্তা মালেকের ভাষ্যগ্রন্থ ইত্যাদি। সচেতন আহলে ইলম ও জীবনীকারগণ উল্লিখিত গ্রন্থগুলোর আলোকেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.-কে যথার্থরূপে মুল্যায়ন করে থাকেন। সেসব কিতাব বাদ দিয়ে ‘আদ দুররুস সামীন’-এর মতো একটি রিসালাকে মাপকাঠি নির্ধারণ করা ও সেটার নিক্তিতে তাঁর মতো বিরাট ব্যক্তিত্বকে নিরূপণ করা যে কেমন বিষয়, তা আশা করি স্পষ্ট হয়েছে।
*******
ব্যাকরণগত, উচ্চারণগত ও কিতাবের শিরোনাম উল্লেখে ভুল
আলোচকের বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধে-নিবন্ধে উলূমে শরীয়া সংশ্লিষ্ট আ’লাম, কিতাবাদি ও ইবারতের পাঠে বেধড়ক ভুলের ছড়াছড়ি দেখা যায়। আলোচিত ভিডিও ক্লিপ থেকে কিছু নমুনা-
(ক) ‘ফারাসাত’। (ক্লিপ ০:১৫)
অথচ সঠিক শব্দ হল ‘ফিরাসাত’।
(খ) কিতাবের নাম হল- فَضْلُ المُبِين فِي المُفَصَّل مِن حَديث النَّبي الأمِين (ক্লিপ ৩:২৬-৩:৩০)
অথচ গ্রন্থটির সঠিক শিরোনাম হল- الفضل المبين من أحاديث النبي الأمين
বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: মাওলানা নুরুল হাসান রাশেদ কান্ধলবীর সম্পাদনা ও তাহকীকে প্রকাশিত ‘আল ফাযলুল মুবীন’ এর ভূমিকা, পৃ. ১৪৭-১৪৯।
(গ) তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. প্রণীত الدُّرُّ الثَّمِيْنُ في مُبَشِّرَاتِ النَّبِيِّ الأَمِيْنِ -এর প্রথম পৃষ্ঠা থেকে কিছু ইবারত পড়েন। তন্মধ্যে নিম্নোক্ত বাক্যটি এভাবে পড়েন-ما لا واسطةً بيني وبينه صلى الله عليه وسلم (ক্লিপ ৭:২৬-৭:৩০)। পরে আবারো পড়েন- ما لا واسطةٌ (ক্লিপ ৮:৩৪)
অথচ সঠিক যবত হল- ما لا واسطةَ بيني وبينه صلى الله عليه وسلم
(ঘ) কিতাবের নাম হল- الدُّرَرُ الثَّمين في مُبشَّرات النبي الأمين (ক্লিপ ৯:৪৫-৯:৫৭)
অথচ সঠিক নাম হল- الدُّرُّ الثَّمِيْنُ في مُبَشِّرَاتِ النَّبِيِّ الأَمِيْنِ
এই ভুলটি কয়েকটি কারণে অত্যন্ত গুরুতর। প্রথমত, তার বর্তমান আলোচনাটি এই কিতাবটি ঘিরেই। দ্বিতীয়ত, তার সামনে কিতাবটি রয়েছে এবং তিনি তা দেখে দেখে ইবারত পাঠ করছেন, আর সেখানে তা সঠিকভাবেই লিখিত আছে। তৃতীয়ত, তিনি পরপর দুইবার নামটি ভুল উচ্চারণ করলেন। চতুর্থত, যদি আমরা الدُّرَرُ শব্দটির ব্যবহার এখানে সঠিক বলে ধরে নেই, তবুও বাক্যটি ভুল। কারণ الدُّرَرُ শব্দটি বহুবচন, সে হিসেবে এর সিফাত الثَّمِيْنَةُ এর পরিবর্তে الثَّمِيْنُ পড়া ব্যাকরণগত সুস্পষ্ট ভুল।
(ঙ) তিনি الدُّرُّ الثَّمِيْنُ في مُبَشِّرَاتِ النَّبِيِّ الأَمِيْنِ কিতাব থেকে দেখেদেখে দ্বিতীয় হাদীসটি পাঠ করলেন। কিন্তু তাতে উদ্ধৃত একটি বাক্য এভাবে পাঠ করেন- فَظَهرَ لي في ذلك الحِين بَعْدَ دقائقِ العُلومِ الشَّرعيةِ (ক্লিপ ১৪:১৫-১৪:২৩)
অথচ সঠিক বাক্যটি তার সামনে খোলা উক্ত কিতাবে এভাবে লেখা আছে-فظهر لي في ذلك الحين بَعْضُ دَقائقِ العُلومِ الشَّرعيةِ
(চ) তিনি আরেকটু সামনে গিয়ে দেখেদেখে পড়েন- هَذه قَلَمُ جَدِّي (ক্লিপ ১৮:০৫-১৮:১০)
অথচ তার সামনে রাখা কিতাবে নির্ভুলভাবে লেখা আছে- هَذا قَلمُ جَدِّي
আলোচকের শেষ বক্তব্য ও আমাদের প্রত্যাশা
মুহতারাম আলোচক বলেন, “উলূমে দীনিয়া নিয়ে লেখা এত সহজ নয়, এত সহজ নয়। এটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার নয়। এটা উপন্যাস লেখা নয়। এটা গল্প রচনা নয় যে, যাচ্ছেতাই লিখে ফেলবে তুমি, যেমন ইচ্ছা লিখে ফেলবে তুমি। কোথায় তোমার প্রস্তুতি? কোথায় তোমার রূহের প্রস্তুতি? কোথায় তোমার ইলমের প্রস্তুতি? কোথায় তোমার আখলাকের প্রস্তুতি? কোথায় তোমার আমলের প্রস্তুতি? একটা কলম হাতে পেয়েছ বলে লেখা শুরু করে দিয়েছ, আর মনে করছ যে কিছু একটা হয়ে গেছ? অসম্ভব! এভাবে না।” (ক্লিপ ২০:০৪-২০:৩৪)
এই কথাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্থানোপযোগী, যা সঠিক সময়ে আল্লাহ তাআলার তাওফীকে মুহতারাম আলোচকের যবানে উচ্চারিত হল। আল্লাহ তাআলা আলোচক, শ্রোতাবৃন্দ এবং আলোচনার পর্যালোচনাকারী ও পাঠকবৃন্দ সবাইকে উক্ত কথাগুলোর ওপর আক্ষরিক অর্থেই আমল করার তাওফীক দান করুন। নিজেদের কথা ও কাজের মুহাসাবা করার শক্তি প্রদান করুন। ইলমী বিষয়ে তাহকীক, ইতকান ও আমানতদারির গুণে গুণান্বিত করুন। আমীন।
.وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين